যাকাতের গুরুত্ব ও সামাজিক প্রভাব | ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি
যাকাতের গুরুত্ব ও সামাজিক প্রভাব
ভূমিকা
ইসলাম হলো একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। শুধু ইবাদত বা আধ্যাত্মিক জীবনের ক্ষেত্রেই নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং নৈতিক প্রতিটি দিকেই ইসলামের রয়েছে দিকনির্দেশনা। ইসলামের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো যাকাত। এটি শুধুমাত্র দান-খয়রাত নয়, বরং ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে তৃতীয় স্তম্ভ।
যাকাত হলো সম্পদশালী মুসলমানের উপর ফরজ করা এক ধরনের আর্থিক ইবাদত, যা সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং গরিব-দুঃখীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় বিশাল ভূমিকা রাখে।
“তারা নামাজ কায়েম করে এবং যাকাত আদায় করে, আর তারা আখেরাতেও দৃঢ় বিশ্বাস রাখে।”
(সূরা লুকমান, আয়াত ৪)
যাকাতের সংজ্ঞা ও অর্থ
আরবি শব্দ “যাকাত” এসেছে “যাকা” ধাতু থেকে, যার অর্থ হলো পবিত্রতা, বৃদ্ধি ও পরিশুদ্ধি। ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে যাকাত হলো—নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের ওপর নির্দিষ্ট হারে গরিব-অসহায় মানুষের মাঝে বন্টন করা একটি ফরজ ইবাদত।
অতএব, যাকাত কেবল দান নয়, বরং এটি একটি ইবাদত, সম্পদের হক আদায় এবং সমাজের মধ্যে ভারসাম্য আনার একটি পূর্ণাঙ্গ ব্যবস্থা।
যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত
- মুসলমান হওয়া – যাকাত শুধু মুসলমানের উপর ফরজ।
- বালেগ ও সুস্থ মস্তিষ্ক – শিশু বা মানসিকভাবে অসুস্থ ব্যক্তির উপর যাকাত ফরজ নয়।
- নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া – সোনা, রূপা, নগদ টাকা, ব্যবসার পণ্য ইত্যাদি নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি হলে যাকাত দিতে হবে।
- সোনা – ৭.৫ তোলা (৮৭.৪৮ গ্রাম)
- রূপা – ৫২.৫ তোলা (৬১২.৩৬ গ্রাম)
- এক বছর পূর্ণ হওয়া – নিসাব পরিমাণ সম্পদ এক বছর পূর্ণ হলে যাকাত দিতে হয়।
- ঋণমুক্ত থাকা – যদি ঋণের কারণে নিসাব পরিমাণ না থাকে তবে যাকাত ফরজ নয়।
ইসলামে যাকাতের গুরুত্ব
১. ফরজ ইবাদত
যাকাত ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। এটি নামাজের মতোই ফরজ ইবাদত। নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদের মালিক হলে বছরে একবার ২.৫% যাকাত দিতে হয়।
২. সম্পদের পরিশুদ্ধি
“তাদের সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ কর, এর দ্বারা তুমি তাদেরকে পবিত্র করবে এবং পরিশুদ্ধ করবে।”
(সূরা তাওবা, আয়াত ১০৩)
যাকাতের মাধ্যমে মানুষের লোভ-হিংসা দূর হয় এবং সম্পদে বরকত আসে।
৩. আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন
যাকাত আদায়কারী বান্দা আল্লাহর নির্দেশ পালন করে এবং তাঁর সন্তুষ্টি অর্জন করে। কোরআনে যাকাত না দেওয়ার জন্য কঠিন শাস্তির হুঁশিয়ারিও রয়েছে।
যাকাতের প্রাপক কারা?
কোরআনে আল্লাহ তাআলা যাকাতের আট শ্রেণির কথা বলেছেন (সূরা তাওবা, আয়াত ৬০):
- গরিব (যাদের কোনো আয় নেই বা খুব কম আয় আছে)
- মিসকিন (যাদের প্রয়োজন পূর্ণ হয় না)
- যাকাত আদায়কারী কর্মকর্তা
- নতুন মুসলমান
- দাস-মুক্তির জন্য
- ঋণগ্রস্ত মানুষ
- আল্লাহর পথে সংগ্রামী (মুজাহিদ)
- মুসাফির (যাত্রাপথে অসহায়)
যাকাতের সামাজিক প্রভাব
১. দারিদ্র্য দূরীকরণ
যাকাত সমাজে ধনী-গরিবের মধ্যে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করে, ফলে দারিদ্র্য কমে যায়।
২. সামাজিক সমতা প্রতিষ্ঠা
যাকাত ধনী-গরিবের ব্যবধান হ্রাস করে, ফলে সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয়।
৩. অর্থনীতির চক্র সচল রাখা
যাকাতের মাধ্যমে দরিদ্ররা অর্থ পায় এবং তা খরচ করলে বাজারে অর্থ প্রবাহ সচল হয়। এতে জাতীয় অর্থনীতি শক্তিশালী হয়।
৪. সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করা
ধনীরা গরিবদের সাহায্য করলে তাদের হৃদয়ে দয়া জন্মায় এবং গরিবদের মনে কৃতজ্ঞতা তৈরি হয়।
৫. অপরাধ কমানো
যখন গরিবরা যাকাতের মাধ্যমে মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে পারে, তখন তারা চুরি-ডাকাতির মতো অপরাধে জড়ায় না। ফলে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
যাকাত না দেওয়ার ক্ষতি
১. আল্লাহর শাস্তির হুঁশিয়ারি
“যারা স্বর্ণ ও রূপা সঞ্চয় করে রাখে আর আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদেরকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সুসংবাদ দাও।”
(সূরা তাওবা, আয়াত ৩৪)
২. অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি
যাকাত আদায় না করলে ধনী আরও ধনী হয়, গরিব আরও গরিব হয়। এতে সমাজে হিংসা, বিদ্বেষ ও অশান্তি বৃদ্ধি পায়।
৩. সম্পদের অশান্তি
যাকাত না দেওয়ার কারণে সম্পদে বরকত কমে যায় এবং নানা ধরনের অশান্তি দেখা দেয়।
উপসংহার
যাকাত কেবল আর্থিক লেনদেন নয়; এটি একটি পূর্ণাঙ্গ সামাজিক কল্যাণব্যবস্থা। ইসলামে যাকাতকে ফরজ করা হয়েছে সমাজ থেকে দারিদ্র্য দূর করতে, ধনী-গরিবের মধ্যে ভারসাম্য তৈরি করতে এবং অর্থনীতিকে সচল রাখতে।
প্রত্যেক মুসলমানের উচিত নিয়মিত যাকাত আদায় করা, যাতে সমাজ কল্যাণের পথে অগ্রসর হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে সঠিকভাবে যাকাত আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমীন।